মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর পরই অভিবাসন বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন। সম্প্রতি দেশটি থেকে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। যাদের মধ্যে একজন হলেন চট্টগ্রামের জাকির হোসেন চৌধুরী। ক্যালিফোর্নিয়ার ডিটেনশন সেন্টারে দীর্ঘ দুই বছর আটক থাকার পর গত ২৩ জুন দেশে ফিরেছেন তিনি। জানিয়েছেন তার দুর্ভোগ ও অসহায়ত্বের কথা। টেলিফোনে জাকির হোসেন চৌধুরী সঙ্গে কথা বলেছেন বীর বাঙালির বিশেষ প্রতিবেদক সজিব খান।
নিচে জাকির হোসেনের গল্প তার নিজ বক্তব্য অনুযায়ী তুলো ধরা হলো।
‘আমি আমেরিকাতে যাই ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে। তারপর সেখানে গিয়ে আমি থাকা শুরু করি। কিন্তু আমার বৈধ কোনো কাগজপত্র ছিলো না। আমি বাহিরের কোম্পানির একটি শীপে মেকানিক্স হিসেবে চাকরি করতাম। তারা আমাকে আমেরিকাতে ল্যান্ড পাস দেয়, তা দিয়ে আমি শপিং করতে যাই। শপিং করতে গিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নেই এখানেই থেকে যাবো। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। পরদিন আমি শীপে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু তারা আমাকে গ্রহণ করেনি। পরে শপিংমলে এক বাংলাদেশি ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল তিনিই চাকরি এবং থাকার ব্যবস্থা করে দেন। আমি লস এঞ্জেলস শহরের একটি সুপার মার্কেটে ক্যাশিয়ার হিসেবে চাকরি করছিলাম। একবছর পর অনেকে পরামর্শ দেয় আমি যেনো বৈধভাবে থাকার আবেদন করি। আমি সেইমতে আমেরিকাতে বৈধভাবে থাকার জন্য আবেদন করলে কতৃপক্ষ আমার আবেদন গ্রহণ করে এবং আমার ইন্টার্ভিউ নেয়।
ইন্টার্ভিউর পর সেদেশের আইন অনুযায়ী ১৮০দিন পর ওয়ার্ক পারমিটের জন্য আবেদন করতে হয়। আমি নিয়মানুযায়ী ১৮০দিন পরই আবেদন করি। আবেদন করার পর তারা আমাকে রিসিট কপি পাঠায় এবং আমাকে জানানো হয় তারা আমার আবেদনটি গ্রহণ করেছেন। আমার কাছ থেকে ছবি চাওয়া হয়, আমি পাঠিয়ে দেই।কিন্তু এর মধ্যে আমেরিকাতে নির্বাচন হয়। ট্রাম্প ক্ষমতায় চলে আসে। ট্রাম্প আসার পর তারা নিয়ম-কানুন অনেক পরিবর্তন করে, আইন পরিবর্তন করে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের জুনের ২১ তারিখে আমাকে ওয়ার্ক পারমিটের ইন্টার্ভিউর জন্য ডাকা হয়। আমি ইন্টার্ভিউ দিতে গেলে ইন্টার্ভিউ নেওয়া শেষে ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে।গ্রেফতার করার কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, আমাকে নাকি গ্রেফতার করা হচ্ছে না, কিছু পেপারসওয়ার্ক আছে সেগুলো সম্পন্ন হবার পর ছেড়ে দেবে।
পুলিশ আমাকে হ্যান্ডকাফ পরাচ্ছিলো। আমি বলছিলাম, আমি তো অপরাধী না, আমাকে হ্যান্ডকাফ লাগাচ্ছেন কেনো। জবাবে তারা জানায়, তারা তাদের আইন অনুযায়ী কাজ করছে। আমার জায়গায় ট্রাম্প হলেও হ্যান্ডকাফ পরানো হতো।
এরপর আমাকে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে তাদের অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে অনেক পেপারসওয়ার্ক করায়, আমার সাক্ষর নেয়। আমার ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়, আই টেস্ট নেয়। তারপর আমাকে বলে, ‘তুমি যদি এই দেশে বৈধভাবে থাকো, আমেরিকা সরকার যদি তোমাকে চাকরি দেয়, তুমি করবা?’ জবাবে আমি বলেছি করবো না কেনো, অবশ্যই করবো।
আমি তাদের জিজ্ঞাস করি আমাকে কখন ছাড়বেন। জবাবে তারা জানায় এখন রাত হয়ে গেছে, তাই কাল সকালে আমাকে ছেড়ে দিবে। কিন্তু তারা আমাকে মিথ্যা কথা বলে আটক করে ফেলে, আমাকে আরা ছাড়া হয়নি। পরদিন তারা আমাকে ডিটেনশন সেন্টার অব ক্যালিফোর্নিয়াতে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে আমাকে দুই বছর আটকে রাখে। এরমধ্যে আমি ২০১৮ সালের জুনে তাদের অনুরোধ করি আমাকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য। আমি ডিপোর্টেশন পেপারে সিগন্যাচার করি। এরপর সেপ্টেম্বরে তারা আমাকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য এয়ারপোর্টে নিয়ে যায়। আমার এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হয়। আমার একটা ব্যাগেজ ছিলো, সেটি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে উঠানো হয়। কিন্তু আমি বিমানে উঠার ঠিক আগ মূহুর্তে নিরাপত্তার অজুহাতে আমাকে বিমানে উঠতে দেওয়া হয়নি।বিমান থেকে আবার আমার ব্যাগেজটা নামিয়ে দেয়। এরপর আবার আমাকে জেলে পাঠানো হয়।এরপর আমি ইমিগ্রেশন পুলিশকে বলি, আপনারা আপনাদের সিস্টেম অনুযায়ী আমাকে জামিন দেন।এর জন্য তারা আমার কাছে যা চায়, আমি মেনে নেবো। কিন্তু তারা আমাকে জামিন দেয়নি।
পরবর্তিতে ২০১৯ সালের ২১ জুন সকালে আমাকে বাংলাদেশে ডিপোর্ট করা হয়। প্রথমে আমাকে কুরিয়া এয়ারলাইন্সে করে দক্ষিণ কোরিয়া পাঠানো হয়। এরপর সেখান থেকে থাইল্যান্ডে হয়ে গত ২৩ জুন আমি বাংলাদেশের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছাই।’
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা শহরের নাজিরপাড়া গ্রামের মৃত নূর মোহাম্মদ চেীধুরীর ছেলে জাকির হোসেন চৌধুরী বর্তমানে খুব অসহায় জীবন-যাপন করছেন। জাকির হোসেনের তিন ছেলে ও স্ত্রী তার রোজগারের উপর নির্ভরশীল।
তিনি জানান, তার বর্তমান আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ।দুই বছর বাহিরের আটক থাকায় পরিবারকে কোনো টাকা পয়সা পাঠাতে পারেনি। তবে লস এঞ্জেলস শহরের শামসুল ইসলাম ও তার আত্বিয় স্বজন ও শ্যালক তার পরিবারকে বিভিন্ন সময়ে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু এরপরেও তার পরিবার ১৫ লাখ টাকার মতো ঋণ হয়ে গিয়েছে। জাকির হোসেন বলেন, আমার এখন কিছু নাই। আমার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। আমাকে কেউ যদি সাহায্য করে আমি হয়তো আমার বাচ্চাদের নিয়ে বাঁচার জন্য কিছু একটা করতে পারবো। আমার বড় ছেলে এবছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। মেঝো ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ছে। আমার ছোট ছেলের বয়স চার বছর। আমি বাহিরে থাকতে তার জন্ম হয়। দুইটা বছর বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ ও সংসার চালানোর জন্য আমি আমার পরিবারকে কিছু দিতে পারিনি।আমি চেয়েছিলাম শীপে ফিরে যেতে। কিন্তু আমি তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।
তিনি জানান, যুক্তরাষ্টের ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কোনো টাকা পয়সা দাবি করেনি। তবে তিনি দেখেছেন ভারত এবং বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে গিয়েছে, তাদের অনেককে টাকা নিয়ে নিয়ে ছাড়া হয়েছে। তিনি বলেন, কারো থেকে ৫০ হাজার ডলার, কারো থেকে৩০ হাজার ডলার, কারো থেকে ২৫ হাজার ডলার। এভাবে বন নিয়ে নিয়ে ছাড়ছে। যারা বন দিতে পারেনি তাদের ডিপোর্ট করা হয়েছে।এরমধ্যে আমার এক পরিচিতি ভাইও ইমিগ্রেশন জেলে আমার সাথে ৬ মাস ছিলো। তাকেও ডিপোর্ট করা হয়।