২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ঢাবির এক অধ্যাপককে ফোন করেছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেই কথোপকথন ফাঁস হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে অডিওটি। আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ নেতারা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বিএনপির ষড়যন্ত্র বলে তোপ দাগে।
গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনামলে এভাবে অসংখ্য কল রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় টেলিভিশন, সংবাদপত্রে সেটিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অসংখ্য বিএনপি নেতাকর্মী, অসংখ্য সমাজকর্মীসহ দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ব্যক্তিগত পর্যায়ের কথোপকথন ফাঁস হয়েছে। সেসব নিয়ে আলোচনা সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। সরকার তাদের ওপর তোপ দেগেছে। অনেকে মব ট্রায়ালের শিকার হয়েছে। জেল, জুলুম, হয়রানির শিকার হয়েছে এসব কল রেকর্ড ফাঁসের ঘটনায়।
নেত্র নিউজের একটা প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল, ইসরায়েল থেকে কেনা স্পাই ওয়ারের মাধ্যমে ব্যক্তি পর্যায়ে চলে নজরদারি। মুঠোফোনের তথ্য হাতিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে সার্বক্ষণিক মুঠোফোনে কি হচ্ছে সেসবও নজরদারির আওতায় রাখা যায় ওই যন্ত্রের মাধ্যমে। এমনকি শেখ হাসিনা পতনের পর গণভবন থেকেও এমন অসংখ্য কলরেকর্ড সংরক্ষিত করা সিডি ক্যাসেট উদ্ধার করা হয়েছে। বিএনপি নেতাসহ অনেকের কল রেকর্ড সেখানে পাওয়া গেছে।
রাজনৈতিক, সমাজকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ বারবার বলে এসেছে, কল রেকর্ড ফাঁস, মানুষের ব্যক্তিগত পর্যায়ে নজরদারি বন্ধ করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবেও এসব নিয়ে নানা প্রতিবাদ এসেছে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর হেভিওয়েট যে কয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এরমধ্যে অন্যতম আলোচিত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। বহু অভিযোগের মধ্যে তার বিরুদ্ধে অন্যতম বড় অভিযোগ মানুষের ব্যক্তিগত কল রেকর্ড করা। যদিও আদালতে জবানবন্দিতে ইসরায়েলি আড়িপাতার যন্ত্র পেগাসাস সফটওয়্যারের বিষয়ে আদালত জানতে চাইলে তিনি দাবি করে বলেন, পেগাসাস বলে কিছু নেই। কোনো মোবাইল ট্র্যাকিং করেননি বলেও দাবি করেন তিনি।
গণমাধ্যমের খবর সরকারের এনটিএমসির পরিচালক ছিলেন এই জিয়াউল আহসান। আর এনটিএমসি তথ্য ও যোগাযোগের ডেটা পর্যবেক্ষণ, সংগ্রহ ও রেকর্ড করার পাশাপাশি ইলেকট্রনিক যোগাযোগ যেমন ফোনকল, ই-মেইল ও সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ইন্টারসেপ্ট করে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ও জিয়াউল আহসান গ্রেপ্তারের পর তাই স্বাভাবিকভাবেই জনগণের দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশিত ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন বন্ধ হবে বলেই ধারণা করা চলে। কিন্তু এরপরও কল রেকর্ড ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। নতুন সরকারের গত দেড় মাসের আমলে শেখ হাসিনার একাধিক কল রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। সেসব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৈরি হয়েছে মব ট্রায়াল।
তারেক রহমানের অডিও রেকর্ডে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, অনুসারীরা যেভাবে উল্লসিত হতো, দলবদ্ধভাবে তোপ দাগতো। একই ভাবে এখন শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া কল রেকর্ডের বেলায়ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে।
৭১ টেলিভিশন কিংবা সময় টেলিভিশন সেই সময় যেভাবে কল রেকর্ড ফাঁস করে রসালো গল্প ফাঁদতো, একই রকম রসালো করে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ফোনালাপ প্রকাশ করছে সংবাদমাধ্যম। মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী তথা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, বছরের পর বছর ধরে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা নাগরিকরাও একই প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন যা আওয়ামী শাসনামলে তাদের দলের নেতাকর্মীরা করতো। (যদিও শেখ হাসিনার কল রেকর্ড ফাঁস ইচ্ছাকৃত মনে হয়েছে)
একটা সভ্য সমাজে, সভ্য রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা নাগরিক পর্যায়ের যেমন কর্তব্য, তেমনই রাষ্ট্রের দায়িত্বও সেটা। রাষ্ট্র সেই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে। আওয়ামী লীগকে যদি ফ্যাসিবাদী বলি, তাদের আমলে কল রেকর্ড ফাঁস করা ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার ছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার সরকার কল রেকর্ড ফাঁস, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অবস্থান না জানিয়ে কি এই ঘটনার ফসল ঘরে তুলতে চাইছে? তারা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কেন নিচ্ছে না? তারাও কি ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে কল রেকর্ডকে হাতিয়ার করতে চাইছে? নাকি না? প্রশ্ন রয়ে যায়। জবাবটা দিতে হবে রাষ্ট্রকেই।
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও সাবেক ছাত্রনেতা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।